ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi movement)

ওয়াহাবি আন্দোলনের উৎস

  • ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ হল ‘নবজাগরণ’। আরব দেশে আব্দুল ওয়াহাব নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের সংস্কারের জন্য এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন ।
  • উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন দিল্লীর খ্যাতনামা মুসলিম নেতা সন্ত ওয়ালিউল্লাহ এবং তাঁর পুত্র আজিজ ।
  • ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির অধিবাসী শাহ সৈয়দ আহমদ ।

ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য : ওয়াহাবি আন্দোলন মূলত ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও অচিরেই তা রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণত হয় । এর উদ্দেশ্য ছিল-

  • ইসলামধর্মের সংস্কার : ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল ‘তারিকা-ই-মহম্মদীয়া’ অর্থাৎ ইসলামধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মহম্মদ প্রদর্শিত পথ। ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামধর্মের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করে মহম্মদের নির্দেশ অনুসরণ করে ইসলামধর্মের সংস্কার করা।
  • ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন : সৈয়দ আহমদ বলেন, ইংরেজ শাসনের ফলে ভারতবর্ষ ‘দার-উল-হার্ব’ বা বিধর্মীর দেশে পরিণত হয়েছে, একে ‘দার-উল-ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামের দেশে পরিণত করতে হবে । এই আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বিধর্মী ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা করা ।
  • অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ : ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ করা। এই কারণে পাঞ্জাবের অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সৈয়দ আহমেদ যুদ্ধ করে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়ার দখল করেছিলেন এবং ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে প্রাণ হারান। বাংলায় তিতুমির পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ওয়াহাবি আন্দোলন কখনই জাতীয় আন্দোলন ছিল না এবং এই আন্দোলনের চরিত্র সাম্প্রদায়িকতা মুক্তও ছিল না । ইংরেজ শাসনের পরিবর্তে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ওয়াহাবি আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi Movement in Bengal):-

  • বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মীর নিশার আলি বা তিতুমির । তিতুমিরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সংগ্রাম বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত হয় ।
  • তিনি কিছুদিন মুসলিম তীর্থস্থান মক্কায় অবস্থান করেন । সেইখানেই তিনি রায়বেরিলির সৈয়দ আহম্মদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিনি ওয়াহাবি আদর্শ অনুসারে ইসলাম ধর্মের সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন ।
  • তিতুমির তার অনুগামীদের ওয়াহাবি আদর্শ মেনে বলেন পির-পয়গম্বরকে মানার প্রয়োজন নেই, মন্দির, মসজিদ তৈরির প্রয়োজন নেই, ফয়েতা বা শ্রাদ্ধশান্তি অনুষ্ঠান করার প্রয়োজন নেই, অনুগামীদের দাড়ি রাখতে হবে, সুদে টাকা খাটানো নিষিদ্ধ কাজ । তিতুমির ও তার অনুগামীরা অন্যান্যদের ওয়াহাবি মতাদর্শে দীক্ষিত করতে শুরু করেন ।
  • কৃষ্ণদেব রায়ের জমিদারি গ্রামে তিতুমিরের জনপ্রিয়তা সবথেকে বেশি বৃদ্ধি পায় । তিতুমির প্রথমে ওই গ্রামে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয় । এতে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ওয়াহাবিদের কাছ থেকে বলপূর্বক জরিমানা আদায় করতে শুরু করেন । ওয়াহাবিদের কর্তৃত্ব খর্বের জন্য তিনি ওয়াহাবিদের দাড়ি রাখার ওপর আড়াই টাকার কর ধার্য করেন । তা ছাড়াও কৃষ্ণদেব রায় আদেশ দিয়ে বলেন তাঁর জমিদারি এলাকার মধ্যে ওয়াহাবি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করলে পাকা ইটের তৈরি বাড়ির ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা ও কাঁচা মাটির বাড়ির ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা কর আদায় করা হবে । এতে তিতুমির ও তাঁর অনুগামীরা ক্ষিপ্ত হন । কর আদায়কে কেন্দ্র করে তিতুমিরের অনুগামীদের সঙ্গে জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের লোকজনদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে ।
  • তিতুমির নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করে ২৪ পরগনা জেলার নারকেলবেরিয়া গ্রামে জনসাধারণের অর্থ সাহায্যে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে নিজের মতো স্থানীয় প্রশাসন চালাতে থাকেন । এই প্রশাসনের প্রধানমন্ত্রী হন মইনুদ্দিন বিশ্বাস, সেনাপতি হন তিতুমিরের ভাগ্নে গোলাম মাসুম এবং মিস্কিন শাহকে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় । তিতুমির এখান থেকে জমিদার, নীলকর এমনকি বারাসাত থেকে বসিরহাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চলা কোম্পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন । তিতুমির সুদখোর মহাজন, নীলকর, জমিদারদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র ও মুসলমানদের নিয়ে সংগঠন তৈরি করে । জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তিতুমীরের প্রচারের ফলে দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণির বহু মুসলমান দলে দলে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ।
  • প্রথম প্রথম ওয়াহাবিদের সংগ্রাম ছিল স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের বিরুদ্ধে । কলকাতার পূর্ব ও উত্তরদিকের গ্রামসমূহ, চব্বিশ পরগনা, নদীয, যশোহর, রাজশাহি, ঢাকা, ফরিদপুর, মালদহ ইত্যাদি স্থানে তিতুমির অনুগামীরা জমিদার ও নীলকরদের বিরোধিতা শুরু করে । জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তিতুমিরের বিবাদকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তাদের বিবাদ বাধে । তিতুমিরের নির্দেশে প্রজারা জমিদারদের খাজনা বয়কট করে । বিদ্রোহীরা দারোগা রামরতন চক্রবর্তীকে হত্যা করে । জমিদার ও নীলকররা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তিতুমিরের বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিপোর্ট জানায় ।
  • তিতুমিরকে দমনের জন্য গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে দশম পদাতিক বাহিনী পাঠান । তিতুমীরকে বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । তিতুমীর তাঁর ৬০০ অনুগামী কাঁচা বেল, ইট, তীর, ধনুক, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে বাঁশের কেল্লা থেকে ব্রিটিশদের উপর আঘাত হানে । ইংরেজ সেনাবাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা ভেঙে যায় । ইংরেজ বাহিনী তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীদের পরাজিত করেন । শেষ পর্যন্ত ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে নভেম্বর এই সংঘর্ষে তিতুমীর তাঁর বহু অনুগামীসহ যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন । তিতুমীরের সেনাপতি গোলাম মাসুম খাঁ ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েন । তাঁকে কেল্লার সামনেই ফাঁসি দেওয়া হয় । এরপর বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের অবসান ঘটে । প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় আরও ঘোরতর ইংরেজ বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন ।
  • অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরীর মতে — ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষক আন্দোলন ।
  • রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন “ It was a movement of the Muslims, by the Muslims and for the Muslims”.
ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সৈয়দ আহমেদ তার দুই অনুচর বিলায়েত আলি ও এনায়েত আলিকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ওয়াহাবি কেন্দ্র স্থাপন করেন । তাঁরা পাটনায় ওয়াহাবি কেন্দ্রের খলিফা নিযুক্ত হন । সৈয়দ আহমেদ কলকাতায় ওয়াহাবি আদর্শ প্রচার করেন । এই আন্দোলন মূলত ইংরেজ বিরােধী হলেও পাঞ্জাবের শিখদের সঙ্গে ওয়াহাবিরা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন । শিখদের বিরুদ্ধে ‘ বালাকোটের যুদ্ধে ‘ সৈয়দ আহমেদ নিহত হন ( ১৮৩১ খ্রি . ) । ওয়াহাবি আন্দোলনের সংগঠনকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে সৈয়দ আহমেদ চারজনকে খলিফা বা ধর্মগুরুর পদে নিয়ােগ করেন । এরা হলেন এনায়েত আলি , বিলায়েত আলি , ফারহাৎ হােসেন ও মহম্মদ হােসেন । তারপর ইয়া-হিয়া আলির উদ্যোগে গঠিত হয় এক কেন্দ্রীয় কমিটি , যার অন্যতম কয়েকজন সদস্য ছিলেন । আবদুল রহিম , আবদুল গফফর , ইলাহি বক্স । আমানুল্লা ছিলেন এই কমিটির সভাপতি । ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রসার সৈয়দ আহমেদের মৃত্যর পর এই আন্দোলন উত্তর – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ , পাঞ্জাব , বাংলা , বিহার , মিরাট , হায়দ্রাবাদ ও অন্যান্য অঞ্চলে ব্যাপক আকার ধারণ করে । ওয়াহাবি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ ওয়াহাবি আন্দোলন শেষপর্যন্ত বিভিন্ন কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় 一 কর্মসূচি ও মানসিকতার অভাব : সঠিক রাজনৈতিক কর্মসূচি , অস্ত্রশস্ত্র এবং সশস্ত্র আন্দোলনের মানসিকতর অভাব এই বিদ্রোহকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছিল । পরিচালন ব্যর্থতা : সুপরিকল্পিত রণনীতির দ্বারা নিম্নবর্গের মানুষ আন্দোলন পরিচালনা করতে পারেনি , ফলে আন্দোলন ব্যর্থ হয় । হিন্দু – বিমুখতা : আন্দোলনের নেতৃবর্গ ভারতের গরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়কে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার কোনাে উদ্যোগ নেয়নি । এমনকি তিতুমীরসহ বেশ কিছু নেতা হিন্দু জমিদারসহ অভিজাতদের আক্রমণ করায় হিন্দু সম্প্রদায় এই বিদ্রোহ থেকে দূরে থাকে । দমন নীতি : ব্রিটিশের তীব্র দমননীতি আন্দোলনকে ব্যর্থ করে ।